হেবার শর্ত এবং কাদেরকে হেবা করা যায়?

মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার তথা সন্তানদের মাঝে যাতে সম্পত্তি নিয়ে গণ্ডগোল বা হট্টগোল না হয় তাই অনেকেই চায় জীবদ্দশায় তার সম্পত্তি নিজের সন্তানদের মাঝে সুষম বণ্টন করে যেতে। আর ব্যক্তি জীবিত অবস্থায় যেহেতু নিজের সম্পত্তি উত্তরাধিকারদের মাঝে আপোষ বণ্টন দলিল করে দেওয়া সম্ভব নয়, তাই নিজের সম্পত্তি নিজের উত্তরাধিকারদের মাঝে নিজের ইচ্ছে মত হেবা করে দেওয়া সম্ভব।

হেবা মূলত একটি দান পত্র, যার মাধ্যমে দাতা গ্রহীতাকে সম্পত্তি তাৎক্ষনিক দান করে দিচ্ছে কোন শর্ত বা বিনিময় ব্যতীত। আজকের পর্বে আমরা জানার চেষ্টা করবো, হেবার শর্ত কি কি, কে কাকে হেবা করতে পারে, হেবা দাতা-গ্রহীতার যোগ্যতা ইত্যাদি যাবতীয় বিষয় নিয়ে। তো চলুন শুরু করা যাক।

 

হেবার শর্ত
কোন মুসলিম ব্যক্তির দ্বারা সম্পত্তির হেবার জন্য প্রধানত তিনটি শর্ত পূরণ করতে হবে। এই শর্তগুলি নিম্নরূপঃ
১। দাতা কর্তৃক হেবার ঘোষণা।
২। গ্রহীতা কর্তৃক হেবা গ্রহণ।
৩। দাতার দ্বারা দখল হস্তান্তর এবং গ্রহীতা কর্তৃক দখল গ্রহণ।

 

হেবা দাতার যোগ্যতা
মুসলিম আইন অনুসারে হেবা করার জন্য হেবার দাতার যেসব যোগ্যতা থাকতে হবে সেগুলো নিম্নরূপঃ

১। মুসলিমঃ যে ব্যক্তি তার সম্পত্তি হেবা করছে অর্থাৎ দাতা, তাকে অবশ্যই মুসলিম হতে হবে। মুসলিমের স্থলে অন্য কেউ মুসলিম আইন অনুসারে হেবা করতে পারবে না।
২। প্রাপ্ত বয়স্কঃ যে ব্যক্তি তার সম্পত্তি হেবা করছে অর্থাৎ দাতা, তাকে অবশ্যই প্রাপ্ত বয়স্ক হতে হবে, অর্থাৎ ১৮ বছর বয়স্ক হতে হবে। তবে, লিগ্যাল বা আইনি অভিভাবকের অভিভাবকত্বের মধ্যে বড় হওয়া নাবালককে ২১ বছর বয়স্ক হতে হবে।
৩। পূর্ণ সম্মতিঃ যে ব্যক্তি তার সম্পত্তি হেবা করছে অর্থাৎ দাতা, তাকে অবশ্যই জেনে শুনে পূর্ণ সম্মতিতে হেবা করতে হবে। হেবা দাতার সম্মতি জোর, জবরদস্তি, অযাচিত প্রভাব মুক্ত হতে হবে।
৪। কোন প্রকার বিনিময় থাকতে পারবে নাঃ ‘No consideration, no contract’, আমরা জানি যে, বিনিময় বা লেনদেন না থাকলে কোন চুক্তি সম্পন্ন হয় না। কিন্তু, হেবা বা উইল বা দান এসব হচ্ছে এর ব্যতিক্রম। হেবার ক্ষেত্রে দাতা গ্রহীতার মাঝে কোন প্রকার বিনিময় থাকতে পারবে না।
৫। সুস্থ মস্তিস্কঃ যে ব্যক্তি তার সম্পত্তি হেবা করছে অর্থাৎ দাতা, তাকে অবশ্যই সুস্থ মস্তিস্কের হতে হবে। দাতা সজ্ঞানে, সুস্থ মস্তিষ্কে হেবা সম্পন্ন করে হবে। পাগল কেউ হেবা করতে পারবে না।
৬। দেউলিয়া হতে পারবে নাঃ যে ব্যক্তি তার সম্পত্তি হেবা করছে অর্থাৎ দাতাকে দেউলিয়া হলে চলবে না। দেউলিয়ার তো সম্পত্তি থাকারই কথা না, কেননা যে দেউলিয়া সে নিজেকে নিঃস্ব ঘোষণা দিয়েই কিন্তু দেউলিয়া হয়েছে। এখন দেউলিয়া কিভাবে আরেকজনকে সম্পত্তি হেবা করে দিবে?
৭। বৈধ মালিকানাঃ যে ব্যক্তি তার সম্পত্তি হেবা করছে অর্থাৎ দাতাকে অবশ্যই উক্ত সম্পত্তির বৈধ মালিকানা অর্জন করতে হবে।গাছে কাঁঠাল গোঁপে তেল’- ভবিষ্যতে আপনি যে সম্পত্তির মালিক হবেন, সেই সম্পত্তি ভবিষ্যতেই আপনাকে হেবা করতে হবে। বর্তমানে যে সম্পত্তির বৈধ মালিকানা আপনার নেই সেটি আপনি হেবা করতে পারবেন না।

 

হেবা গ্রহীতার যোগ্যতা
মুসলিম আইন অনুসারে হেবা গ্রহণ করার জন্য হেবা গ্রহীতার যেসব যোগ্যতা থাকতে হবে সেগুলো নিম্নরূপঃ
১। যে ব্যক্তি তার সম্পত্তি হেবা করছে অর্থাৎ দাতা, তাকে অবশ্যই মুসলিম হতে হলেও যাকে হেবা করা হবে বা যে হেবা গ্রহণ করবে, তার কোন ধর্মীয় বাধা নেই। দানকারী যে কোন ধর্মের হতে পারে, মুসলিম বা অমুসলিম।
২। যে ব্যক্তি তার সম্পত্তি হেবা করছে অর্থাৎ দাতা, তাকে অবশ্যই প্রাপ্ত বয়স্ক হতে হলেও হেবার গ্রহীতার বয়স নিয়ে কোন বাধ্যবাধকতা নেই। হেবার গ্রহীতা যেকোনো বয়সের হতে পারে এমনকি অনাগত সন্তানকেও হেবা করে দেওয়া যেতে পারে। তবে, অনাগত সন্তানের ক্ষেত্রে অবশ্যই তাকে মায়ের গর্ভে থাকতে হবে।

 

মুসলিম আইন অনুসারে কাদেরকে হেবা করা যায়?
আপনি আপনার সম্পত্তি মুসলিম আইন অনুসারে কাকে কাকে হেবা করতে পারবেন, সেটি মনে রাখার সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে আপনার উপরের দিকে দুই ডিগ্রী আর নিচের দিকে দুই ডিগ্রী এবং স্বামী/স্ত্রীর সাথে ভাই বোনকে। যেমন, আপনার উপরের দিকে আপনার বাবা এবং বাবার উপরের ডিগ্রী হচ্ছে বাবার বাবা মা অর্থাৎ, দাদা দাদী। আবার, আপনার উপরের দিকে আপনার মা এবং মায়ের উপরের ডিগ্রী হচ্ছে মায়ের বাবা মা অর্থাৎ, নানা নানী।
এবার, নিচের দিকে আপনার প্রথম ডিগ্রী হচ্ছে আপনার ছেলে এবং ছেলের নিচে আরেক ডিগ্রী হচ্ছে ছেলের ছেলে এবং মেয়ে অর্থাৎ, ছেলের ঘরের নাতি নাতনি। একইভাবে, নিচের দিকে আপনার প্রথম ডিগ্রী হচ্ছে আপনার মেয়ে এবং মেয়ের নিচে আরেক ডিগ্রী হচ্ছে মেয়ের ছেলে এবং মেয়ে অর্থাৎ, মেয়ের ঘরের নাতি নাতনি।

আর, পাশাপাশি হচ্ছে আপনার স্বামী বা আপনার স্ত্রী এবং আপনার ভাই বোন। আরও সহজ করে নাম্বারিং করে দেখাচ্ছি যাতে কোন কনফিউশন না থাকে। আপনি আপনার সম্পত্তি যাদের হেবা করতে পারবেন

 

১। বাবা
২। দাদা
৩। দাদী
৪। মা
৫। নানা
৬। নানী
৭। স্বামী/স্ত্রী
৮। ছেলে
৯। ছেলের ছেলে
১০। ছেলের মেয়ে
১১। মেয়ে
১২। মেয়ের ছেলে
১৩। মেয়ের মেয়ে
১৪। ভাই
১৫। বোন

 

এই কয়জনকেই আপনি আপনার সম্পত্তি হেবা করতে পারবেন। আবার, আপনি নিজে যাদের এই লিস্টের মধ্যে আছেন, তারাও আপনাকে হেবা করতে পারবে।
সম্পত্তি হস্তান্তরের জন্য স্বাভাবিক সরকারী খরচ দিতে হলেও নিজেদের মধ্যে সম্পত্তি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে যাতে বাড়তি খরচ বহন করতে না হয়, সেজন্য মুসলিম আইন অনুযায়ী নিজেদের মধ্যে সম্পত্তি হস্তান্তরের ক্ষেত্রে স্বাভাবিক সাফ কবলার পরিবর্তে হেবার বিধিবিধান প্রণয়ন করা হয়েছে, যাতে নামমাত্র রেজিস্ট্রেশন খরচ দিয়ে সম্পত্তি হস্তান্তর করা যায়। মুসলিম আইন অনুসারে হেবার রেজিস্ট্রেশন ফি ১০০ টাকা। এর বাহিরে সামান্য কিছু ফি সহ দলিল লেখকের ফি পরিশোধের মাধ্যমেই অনায়াসে হেবা দলিল সম্পন্ন করা যায়।



কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.